নিয়ন্ত্রিত বা প্রথাগত শিক্ষা ।।Formal Education
নিয়ন্ত্রিত বা প্রথাগত শিক্ষা ।।Formal Education
আদিম সমাজব্যবস্থায় মানুষের জীবন ছিল সরল। তাই সে যুগে প্রথাগত শিক্ষার প্রয়োজন দেখা দেয়নি। গৃহপরিবেশে পরিবারই শিশুর শিক্ষার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ছিল। কিন্তু সমাজজীবনে জটিলতা বৃদ্ধির কারণে নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব ঘটলে মানুষ বুঝতে পারে যে, প্রশিক্ষণ ছাড়া ওই সমস্ত সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ফলে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন দেখা দেয়। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা বা প্রথাগত শিক্ষা (Formal Education)।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদগণ নানান সময়ে নানান ভাবে প্রথাগত শিক্ষার সংজ্ঞা নিরূপণ করেছেন। এখানে কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হল-
► সমাজ দ্বারা নির্ধারিত সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সচেতনভাবে এবং উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে নির্দিষ্ট পাঠক্রম অনুসারে শিক্ষার্থীদের যে বিশেষ শিক্ষাদান করা হয়, তাই হল প্রথাবদ্ধ বা বিধিবদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা।
►নিয়ন্ত্রিত বা প্রথাগত শিক্ষার বৈশিষ্ট্য :
বিধিবদ্ধ শিক্ষার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সমাজ তার নিজের প্রয়োজনে বিদ্যালয় স্থাপন করে। বহু বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি বর্তমানে নিয়ন্ত্রিত রূপ পেয়েছে। বর্তমান কালে নিয়ন্ত্রিত বা প্রথাগত শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
(1) নির্দিষ্ট লক্ষ্য অনুযায়ী পরিকল্পিত: নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা পরিকল্পিত হয় নির্দিষ্ট লক্ষ্যের ভিত্তিতে। দর্শন,মনোবিদ্যা, সামাজিক প্রত্যাশা প্রভৃতিকে ভিত্তি করে এক্ষেত্রে শিক্ষার লক্ষ্য স্থির করা হয়ে থাকে।
(2) নির্দিষ্ট সূচি দ্বারা সীমাবদ্ধ: নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার একটি নির্দিষ্ট সূচি থাকে। কয়েকটি নিয়মনীতির ওপর ভিত্তি করে এই শিক্ষা প্রদান করা হয়। সুপরিকল্পিত নির্দেশের মাধ্যমে এই ধরনের শিক্ষা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চালিত হয়।
(3) নির্দিষ্ট পাঠক্রম: নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার একটি সুনির্দিষ্ট এবং সুপরিকল্পিত পাঠক্রম থাকে। ব্যক্তির চাহিদাও সমাজের প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে ওই পাঠক্রম নির্ধারণ করা হয়।
(4) যোগ্য শিক্ষক দ্বারা প্রদত্ত: নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, এই শিক্ষা যোগ্য এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত হয়।
(5) কঠোর শৃঙ্খলা: নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় কঠোর শৃঙ্খলা দেখা যায়। শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক উভয়কেই এই শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। শৃঙ্খলার অভাব দেখা দিলে নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার কার্যক্রম বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
(6) নির্দিষ্ট বয়সের শিক্ষার্থী নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের বয়স আগে থেকেই নির্দিষ্ট করা থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শিক্ষার্থীদের 3+ বছর বয়সে প্রাক্সাথমিক বিদ্যালয়ে এবং 6+ বছর বয়সে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভরতি করা হয়।
(7) নির্দিষ্ট স্থান: নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী প্রত্যেককেই একটি নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হতে হয়। শিক্ষার স্তর অনুযায়ী শিক্ষার্থীকে প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে হয়। শিক্ষকরাও সেইসব স্থানে উপস্থিত হয়ে তাঁদের কাজ করেন।
(৪) নিয়মিত উপস্থিতি: নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় ছুটির দিনগুলি ছাড়া প্রতিদিনই নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষার্থীকে শিক্ষালয়ে উপস্থিত হতে হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শিক্ষালয়ে থাকতে হয়।
(9) শিক্ষক-শিক্ষার্থীর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক: নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক পরস্পর মুখোমুখি আলোচনায় অংশ নেয়। শিক্ষক যেমন শিক্ষার্থীকে পড়ান, শিক্ষার্থীরাও তেমনই শিক্ষককে প্রশ্ন করে। এই মিথস্ক্রিয়ার ফলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের
মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।
(10) নিয়মিত পরীক্ষা: নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় শিক্ষার্থী পাঠ্য বিষয়গুলির ওপর কতখানি জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করেছে তা জানার জন্য নিয়মিত পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।
(11) রাষ্ট্রের ভূমিকা: অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় আর্থিক দায়দায়িত্ব এবং পরিচালনার ভার রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকে। দেশের শিক্ষাপরিকল্পনা, পাঠক্রম তৈরি, নীতিনির্ধারণ, পরিচালনব্যবস্থা সবই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের দ্বারা পরিচালিত হয়।
► নিয়ন্ত্রিত ভাব প্রথাগত শিক্ষার ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা :
একটি নির্দিষ্ট সামাজিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থার বিশেষ সুবিধা থাকলেও এর সীমাবদ্ধতাও কম নয়।সেইসব সীমাবদ্ধতা বা ত্রুটিগুলি হল-
(1) যান্ত্রিক ও কৃত্রিম পদ্ধতি: এটি একটি যান্ত্রিক এবং কৃত্রিম শিক্ষাপদ্ধতি। কঠোর নিয়মশৃঙ্খলার জালে আটক থাকায় এক্ষেত্রে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী যান্ত্রিকভাবে শিক্ষালয়ে আসে, নির্দিষ্ট সূচি মেনে শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ করে। চার দেয়ালে ঘেরা এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েই হাঁপিয়ে ওঠে।
(2) সুযোগসুবিধার অভাব: স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশে একদিকে প্রবল হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অন্যদিকে শিক্ষা বিষয়ে জনগণের বেড়ে চলা চাহিদা-এই দুটির মধ্যে সামঞ্জস্য আনার জন্য যে-পরিমাণ নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রয়োজন ছিল বা আছে তার ব্যবস্থা করা এখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
(3) শিক্ষকনির্ভরতা: নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা মূলত শিক্ষকনির্ভর প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে উপযুক্ত পড়ানোর কৌশলের ওপর। কিন্তু দেশের অনেক নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সে-কাজে সক্ষম ও যোগ্য শিক্ষকের অভাব দেখা যায়।
(4) বৈচিত্র্যহীনতা: নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার পাঠক্রমে বৈচিত্র্যের অভাব লক্ষণীয়। এই শিক্ষায় একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলকভাবে একই বিষয়ে পড়াশোনা করতে হয়। ফলে নিজস্ব বুচি, চাহিদা, আগ্রহ এবং সামর্থ্য অনুযায়ী পাঠক্রম শিক্ষার্থীরা পায় না।
(5) অপরিবর্তনশীলতা: নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় পাঠক্রম পূর্বনির্দিষ্ট হয় বলে যখনতখন প্রয়োজনমাফিক তাতে রদবদল করা যায় না। তাই দরকারমতো বিভিন্ন বিষয়ের ওপর সাম্প্রতিকতম তথ্য সবসময় পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। ফলে এই শিক্ষা থেকে সর্বাধুনিক তথ্য লাভ করার ক্ষেত্রে সমস্যা থেকে যায়।
(6) নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়কেই একটা নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষালয়ে উপস্থিত হতে হয়। বিভিন্ন কারণে অনেক সময় শিক্ষার্থীরা ওই নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষালয়ে হাজির হতে পারে না। ফলে তারা পিছিয়ে পড়ে।
(7) পরীক্ষাকেন্দ্রিকতা: নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা মূলত পরীক্ষাকেন্দ্রিক। পরীক্ষায় সফল হওয়া বা ভালো ফল করাটাই এখানে শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য। ফলে এই শিক্ষার দ্বারা শিক্ষার্থীর নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ যথাযথভাবে ঘটে না। এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা কয়েকটি বাঁধাধরা প্রশ্নোত্তর মুখস্থ করে কোনোরকমে পরীক্ষায় পাশ করে। বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে না।
(৪) শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের অবনতি: বর্তমানে নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সুসম্পর্ক পাঠক্রমের চাপে ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর ওপর জোর করে পাঠক্রমের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও সামর্থ্যকে বিবেচনা করা হয় না।
(9) সীমিত প্রবেশপথ নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার ক্ষেত্রে যে-কোনো স্তরে মাত্র একটিই প্রবেশপথ থাকে। শিক্ষার্থী যদি সময়মতো ওই নির্দিষ্ট পথে কোনো শ্রেণিতে ভরতি হতে না পারে, তাহলে সেই শিক্ষাবর্ষে তার শিক্ষার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়।
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার বেশ কিছু ত্রুটি থাকলেও এই শিক্ষাব্যবস্থাটি আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রধান স্থান অধিকার করে আছে। সরকার বা রাষ্ট্র যেহেতু এই শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাই এই শিক্ষার উপাদানগুলি জনসাধারণের উপযোগী করে এবং সব দিক বিচার বিবেচনা করে প্রস্তুত করার চেষ্টা করা হয়। তাই বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও অনিয়ন্ত্রিত ও প্রথাবহির্ভূত শিক্ষার তুলনায় এই নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার ওপরেই অধিকাংশ মানুষ বেশি আস্থা রাখেন।
► নিয়ন্ত্রিত বা প্রথাগত শিক্ষার প্রতিষ্ঠান-বিদ্যালয় :
আধুনিক সমাজব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রিত বা প্রথাগত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হল বিদ্যালয়। বহু প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন দেশে বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়। বিদ্যালয় তথা স্কুল শব্দটি 'স্কোহল' (Skhole) নামক একটি গ্রিক শব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে। এর অর্থ হল 'অবসরকালীন সময়ে একটি তত্ত্বগত জ্ঞানের বিশেষ আলোচনা'। বাস্তবে স্কুল বা বিদ্যালয় হল এমনই এক প্রতিষ্ঠান যেখানে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীরা এক নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হন এবং নির্দিষ্ট রীতিনীতি মেনে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কোনো পাঠক্রম অনুশীলনে সহায়তা করেন।