ভারতবর্ষে বার্ধক্যের সমস্যা || The problem of aging in India
ভারতবর্ষে বার্ধক্যের সমস্যা || The problem of aging in India
মানুষের জীবনচক্রে শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও প্রৌঢ়ত্ব পেরিয়ে একসময় আসে বার্ধক্য। জীবনচক্রের পরিণতিতে বার্ধক্যের আগমন অবশ্যম্ভাবী। এইসময় মানবশরীরের সামর্থ্য হ্রাস পায়; সেইসঙ্গে লোপ পায় আর্থিক সংগতিও।
ধারণা: বার্ধক্যের সূচক হিসেবে একটি বিশেষ বয়ঃসীমার কথা বলা হয়। সাধারণভাবে বলা যায়, চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের বয়সই হলো বার্ধক্যের নির্দেশক। এই বয়সসীমা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যেমন-আমেরিকায় ৬৫ বছর, কোরিয়াতে ৪৫ বছর প্রভৃতি। তবে ভারতবর্ষে ৬০ বছর বয়সকেই বার্ধক্যের সূচক বলে মেনে নেওয়া হয়েছে।
অধ্যাপক বিশ্বনাথ ঘোষ এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন- "Being old is the last stage-the last frontier of our lives."
সমস্যাসমূহ: সম্যকভাবে অবহিত হওয়ার জন্য বার্ধক্যের সমস্যাগুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
1. জৈবিক ও শারীরিক সমস্যা
2. সামাজিক সমস্যা
3. অর্থনৈতিক সমস্যা
4. মানসিক সমস্যা
1. জৈবিক ও শারীরিক সমস্যা: বৃদ্ধদের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো জৈবিক ও শারীরিক সমস্যা। এইসময় মানুষের স্বাস্থ্য বিপর্যয় ঘটে। স্নায়ু ও পেশিসমূহের ক্রমশ স্থূলতা ও শিথিলতা, দৈহিক গঠনের পরিবর্তন, জৈবিক ক্ষয়ক্ষতি প্রভৃতি কারণে এইসময় দৈহিক সক্ষমতা হ্রাস পায়। এছাড়া ফুসফুসের গঠনতন্ত্রের অবক্ষয়, স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যাঘাত, দেহত্বকের নমনীয় তত্ত্বসমূহের অবক্ষয়, দৃষ্টিশক্তির ক্ষীণতা, হাড়ের অবক্ষয়, অনিদ্রা প্রভৃতি সমস্যা দেখা যায়।
2. সামাজিক সমস্যা: বৃদ্ধকালে মানুষ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। যেমন-অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী থাকার সময় (যৌবন ও প্রৌঢ়কালে) ব্যক্তি যে ধরনের কর্তৃত্ব বা গুরুত্ব পরিবারে লাভ করে-বয়স্ক ব্যক্তিরা অর্থনৈতিকভাবে সচল না থাকায় পরিবারে ধীরে ধীরে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে; তারা ক্রমশ সংসারের বোঝা হিসেবে প্রতিপন্ন হয়। এছাড়াও অর্থনৈতিকভাবে হীনবল হয়ে পড়ায় বৃদ্ধদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা লক্ষ করা যায়।
চাকরিজীবন থেকে অবসর গ্রহণের ফলে বৃদ্ধ ব্যক্তিরা নিজের বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে তারা ক্রমশ নিঃসঙ্গ ও একাকী হয়ে পড়ে।
3. অর্থনৈতিক সমস্যা: বৃদ্ধদের আর্থিক সমস্যাও কম নয়। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার ফলে উপার্জন আর থাকে না বললেই চলে। শারীরিক অক্ষমতার কারণে তারা নতুন করে কোনো অর্থনৈতিক উদ্যোগ-আয়োজনে যোগদানও করতে পারে না। সমগ্র জীবনের সঞ্চিত অর্থ সন্তানদের পড়াশোনা, বিবাহাদি, পারিবারিক খরচ প্রভৃতির পেছনেই ব্যয় হয়ে যায়। সেইসময় স্বভাবতই আর্থিক মনোবল ক্ষীণ হয়ে পড়ে এবং বার্ধক্যজনিত চিকিৎসার কারণে অনেক সময় অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হয়।
4. মানসিক সমস্যা: বার্ধক্যে মানসিক সমস্যাসমূহই সর্বাধিক পীড়াদায়ক। এইসময় বৃদ্ধদের মধ্যে মানসিক সক্রিয়তার অভাব ঘটে, আত্মবিশ্বাস হ্রাস পায়, নতুন কিছু শেখার ক্ষমতা বা প্রবণতা থাকে না, স্মৃতিশক্তি লোপ পায়, সম্পাদিত কাজকর্ম উৎকর্ষহীন হয়ে পড়ে, হীনম্মন্যতা দেখা যায়, নিজেদের জীবন নিজেদের কাছেই বোঝা বলে মনে হয়। এছাড়া অসুস্থতার আশঙ্কা বা মৃত্যুভয়ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সৃষ্টি করে।
সমস্যা সমাধানমূলক ব্যবস্থা: ভারতে বৃদ্ধদের সাহায্যের জন্য নানা কর্মসূচি, পরিকল্পনা ও প্রয়োগ পরিচালিত হয়-
i. ভারত সরকার ৬০ ও তার অধিক বয়স্ক মানুষদের জন্য কতকগুলি 'দিবা পরিচর্যা কেন্দ্র' তৈরি করেছে, যার মাধ্যমে পরিবারের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে সেখানে পরিবারের পরিপূরক হিসেবে বয়স্ক ব্যক্তিদের দায়ভার বহন করা হয়। সমগ্র দেশে এরকম ১২৫টি কেন্দ্র চালু রয়েছে।
ii. গ্রাম, শহর ও বিস্তীর্ণ এলাকায় বৃদ্ধদের জন্য উন্নতমানের চিকিৎসা পরিষেবা সুলভে লাভ করার জন্য চালু করা হয়েছে 'ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা পরিষেবা'।
iii. সহায়-সম্বলহীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আশ্রয়দানের উদ্দেশ্যে প্রায় প্রতিটি জেলায় সরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে 'বৃদ্ধাশ্রম'।
iv. বয়স্ক ব্যক্তিবর্গকে বিভিন্ন রকম অপ্রাতিষ্ঠানিক সুযোগসুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে 'অপ্রাতিষ্ঠানিক পরিষেবা কেন্দ্র' গড়ে তোলা হয়েছে।
v. কিছু কিছু ক্ষেত্রে বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা প্রভৃতি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
vi. দারিদ্র্যসীমার নীচে অবস্থিত 65 বছরের বেশি বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য 'কেন্দ্রীয় অন্নপূর্ণা প্রকল্প' গ্রহণ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে মাসে 10 কিলো করে চাল বা গম বিনামূল্যে বৃদ্ধদের প্রদান করা হবে।