শিক্ষায় আধুনিক শিক্ষকের ভূমিকা || Role of modern teacher in education
শিক্ষায় আধুনিক শিক্ষকের ভূমিকা || Role of modern teacher in education
পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় শিক্ষকের ভূমিকাকে নতুনভাবে দেখা প্রয়োজন। পূর্বে শিক্ষকের একমাত্র ভূমিকা ছিল অকণ বা শিক্ষাদান। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকের প্রধান ভূমিকা শিক্ষাদান হলেও পাশাপাশি একাধিক ভূমিকা পালনের কথা বলা হয়। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষকের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
(1) শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় শিক্ষকের ভূমিকা: শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় শিক্ষকের ভূমিকাকে প্রধানত তিনটি দিক থেকে বিবেচনা করা হয়① শিখন সহায়ক, ② সংযোগরক্ষাকারী এবং ③ মাধ্যম।
• শিখন সহায়কের ভূমিকা: (i) শিক্ষক পাঠ বিষয়কে সহজ ও সুষ্ঠুভাবে শিক্ষার্থীদের নিকট তুলে ধরেন।
(ii) বিষয়বস্তুকে মনস্তত্ত্ব এবং যুক্তিসম্মতভাবে সংগঠিত করে শিক্ষার্থীদের শিখনকে সহজ করে তোলেন। (iii) শিক্ষার্থীদের বয়স, বোধগম্যতার স্তর এবং পাঠ্য বিষয়ের চাহিদা পুরণ করে তিনি পাঠদানের কৌশল স্থির করেন।
(iv) বিষয়টি শিক্ষার্থীদের কত জরুরি তা উপলব্ধিতে তিনি সাহায্য করেন।
(v) প্রশ্নোত্তরকালে তিনি প্রয়োজনমতো সংকেত সরবরাহ করেন।
(vi) অনেক সময় বিভিন্ন কারণে শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে সক্রিয় হয় না। শিখন সমস্যাক্রান্ত এ ধরনের শিক্ষার্থীরা যাতে সমস্ত বয়সের বাধা অতিক্রম করে স্বাভাবিক শিক্ষার্থীদের মতো আচরণ করে, সে ব্যাপারে শিক্ষক উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করেন।
(vii) যে সমস্ত শিক্ষার্থীদের বিষয়গত দুর্বলতা আছে, যারা পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল করতে পারছে না-তাদের নির্দিষ্ট করে সংশোধনমূলক শিক্ষণব্যবস্থা গ্রহণে শিক্ষক উদ্যোগী হবেন।
(viii) শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের বিষয়বস্তুর ওপর ব্যাখ্যা যদি শিক্ষার্থীরা বুঝতে সক্ষম না হয়, সেক্ষেত্রে তিনি বিষয়টিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করে শিক্ষার্থীদের বোঝার মতো করে উপস্থাপন করেন।
(ix) শিক্ষক শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে স্থান গ্রহণে সাহায্য করেন। যাদের দৃষ্টিশক্তি এবং শ্রবণশক্তি অপেক্ষাকৃত কম, তাদেরকে সামনের সারিতে বসার সুব্যবস্থা করেন।
(x) শিক্ষণ পরিস্থিতি যাতে শিখনের অনুকূল হয় তা রচনায় তিনি সচেষ্ট হন।
(xi) প্রয়োজনমতো তিনি বক্তব্য একাধিকবার উপস্থাপন করেন। নতুন জ্ঞানকে অর্জিত জ্ঞানের সঙ্গে সমন্বিত করে উপস্থাপন করেন।
• সংযোগরক্ষাকারী ভূমিকা: (1) সহজ ও সরল ভাষা ব্যবহার করে, আধুনিক শিক্ষোপকরণের সাহায্যে শিক্ষক পাঠ্যবিষয়টি শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করে সংযোগরক্ষাকারী হিসেবে কাজ করেন।
(ii) বিশেষ তথ্য, জ্ঞান ও দক্ষতা আয়ত্ত করার লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রেষণা স্যার করেন।
(iii) তাদের মনোযোগী এবং অনুভূতিশীল করে তোলেন, যাতে শিক্ষার্থীরা প্রতিক্রিয়া করতে উৎসাহী হয়। (iv) যেসব শিক্ষার্থী নানা কারণে শ্রেণিকক্ষে নিষ্ক্রিয় থাকে তাদের সক্রিয় এবং মনোযোগী করতে বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করেন।
(v) সার্থক সংযোগরক্ষাকারীর ভূমিকা পালন করার জন্য শিক্ষক বিভিন্ন ধরনের উপকরণ যেমন-চার্ট, মডেল, প্রজেক্টার, ভিডিয়ো, টেপরেকর্ডার ইত্যাদি প্রয়োজনমতো ব্যবহার করেন।
(vi) উত্তম সংযোগ রক্ষার জন্য শিক্ষক পাঠদান কৌশল ব্যবহারে নমনীয়তা অবলম্বন করেন। কখনও বক্তব্য রাখেন, কখনও শিক্ষার্থীদের ছোটো ছোটো দলে বিভক্ত করে টিউটোরিয়াল ক্লাস করেন, কখনও আলোচনা করেন এবং কখনও শ্রেণিকক্ষে আলোচ্য বিষয়ের ওপর কিছু প্রদর্শন করেন।
(vii) সংযোগরক্ষার ক্ষেত্রে তথ্য প্রেরণকারী ও তথ্য গ্রহণকারী উভয়েই সক্রিয় হলে সংযোগ একদিকে যেমন শক্তিশালী হয় অন্যদিকে তেমনি স্থায়ী হয়। শিক্ষক (প্রেরক) তাই শিক্ষার্থীদের (গ্রাহক) সক্রিয় করে তুলতে প্রশ্ন করেন।
(viii) এ ব্যতীত গ্রহণকারী যখন জানতে পারে, সে কী পরিমাণে গ্রহণে সক্ষম হয়েছে, তখন সে তথ্যগ্রহণে আরও উৎসাহবোধ করে যার ফলে সংযোগরক্ষার কাজটি আরও সার্থক হয়। এজন্য শিক্ষক মাঝে মাঝেই শিক্ষার্থীদের সাফল্য সম্পর্কে অবহিত করেন। একেই আমরা 'ফিডব্যাক' বলি।
(ix) শিক্ষক কেবলমাত্র জ্ঞান সংযোগকারীর ভূমিকা পালন করেন না। শিক্ষাদান কালে তাঁর আবেগ অনুভূতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চালিত করেন। যার ফলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা-শিখন প্রক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে এবং সংযোগরক্ষার কাজটি আরও শক্তিশালী হয়।
(x) শিক্ষকের সংযোগরক্ষার কাজটি কেবলমাত্র শ্রেণিকক্ষেই সীমাবদ্ধ থাকে না। শ্রেণিকক্ষের বাইরেও এর ভূমিকা দেখা যায়। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নিকট 'মডেল'। তাঁর আদর্শ, পরামর্শ শিক্ষার্থীরা অনুসরণ করে এবং জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আচরণে প্রতিফলন ঘটায়। অর্থাৎ শিক্ষক শুধু প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় সংযোগরক্ষাকারীর ভূমিকা পালন করেন তা নয়। পরোক্ষভাবেও সংযোগরক্ষার কাজ করেন। বস্তুতপক্ষে, শিক্ষক সংযোগ রক্ষার ভূমিকা যত সুষ্ঠুভাবে পালন করেন শিক্ষণ প্রক্রিয়ার উৎকর্ষের মাত্রা তত বৃদ্ধি পায়।
• মাধ্যমের ভূমিকা: (i) বিদ্যালয় এবং কমিউনিটি উভয়ের পারস্পরিক বিকাশের জন্য শিক্ষক বিদ্যালয় এবং কমিউনিটির মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যম হিসেবে সক্রিয় হবেন।
(ii) এ ছাড়া বিদ্যালয় এবং শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর আচার-আচরণ এবং শিক্ষাগত পারদর্শিতা সম্পর্কে অভিভাবকদের সচেতন করার দায়িত্ব শিক্ষক পালন করেন।
(2) সাম্প্রতিকতম জ্ঞান সম্পর্কে সচেতনতা: বর্তমান দ্রুত পরিবর্তনশীল সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং
জ্ঞানের জগতের সঙ্গে সংগতি রেখে শিক্ষক নিজেকে সমৃদ্ধ করবেন। নিজের বিষয় সম্পর্কে সাম্প্রতিকতম জ্ঞান অর্জনে শিক্ষক সর্বদা সচেষ্ট হবেন। পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা যাতে নিজেরাই জ্ঞান অর্জনে দক্ষতা অর্জন করে সেদিকে তিনি লক্ষ রাখবেন। অর্থাৎ শিক্ষক জ্ঞান-অর্জনের সমাজ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন।
(3) প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের প্রতি বিশেষ ভূমিকা: প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার্জনে যে বিশেষ বাধা এবং তাদের জ্ঞানমূলক, প্রাক্ষোভিক এবং ভাষাগত আচরণ সম্পর্কে শিক্ষক সচেতন হবেন। এবং প্রয়োজনমতো ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন।
(4) শিক্ষাপ্রযুক্তি এবং শিক্ষক: যোগাযোগব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি এবং বর্তমান উন্নত শিক্ষাপ্রযুক্তি সম্পর্কে শিক্ষক অবহিত হবেন এবং তার উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে নিজের ভূমিকাকে আরও বিজ্ঞানসম্মত ও উৎকর্ষের স্তরে নিয়ে যেতে প্রয়াসী হবেন।
(5) শিক্ষার্থীদের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি করা: শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনে উৎসাহ দেবেন এবং কৌতূহলী এবং অনুসন্ধিৎসাপ্রবণ করে তুলবেন।
(6) প্রশাসনিক এবং সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিতে অংশগ্রহণ: আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষকের কাজ কেবলমাত্র শিক্ষাদানেই সীমাবদ্ধ থাকে না। শিক্ষক বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে যেমন ছাত্র ভর্তি, সময়তালিকা প্রস্তুত, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির রেকর্ড রাখা, সর্বাত্মক বিবরণীপত্র প্রস্তুত, আলোচনাচক্র সংগঠন করা ইত্যাদি কাজেও অংশগ্রহণ করেন। বিভিন্ন ধরনের সহপাঠক্রমিক কাজেও শিক্ষককে নেতৃত্ব দিতে হয়।
(7) পরামর্শদান: বৌদ্ধিক এবং প্রাক্ষোভিক আচরণগত সমস্যার সমাধানে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দেবেন। শিক্ষার্থীদের ক্ষমতা, প্রবণতা এবং আগ্রহ অনুযায়ী পাঠক্রম নির্দেশনায় শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সাহায্য করবেন। সবশেষে বলা যায় শিক্ষার পরিধি ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে এবং এই অবস্থায় শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে শিক্ষককে আগামী দিনে নতুন নতুন ভূমিকা পালন করতে হবে।